আসমা অন্বেষা
বর্ণবাদ বা রেসিজম সারা পৃথিবীতে বিরাজমান। বিভিন্ন মানুষ একে বিভিন্নভাবে দেখেন বা পরিমাপ করেন। রেসিজম কখনো গায়ের চামড়ার রঙ দিয়ে হতে পারে, কখনো আঞ্চলিকতা দিয়ে হতে পারে, কখনো গোত্র দিয়ে হতে পারে, কখনো বর্ণ দিয়ে হতে পারে। কিছু কিছু সংজ্ঞা অনুসারে, কোন মানুষের আচরণ যদি কখনো তার জাতি বা বর্ণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটি অন্য কারও জন্য ক্ষতিকর না হলেও তাকে বর্ণবাদ বলা হবে। অন্যান্য সংজ্ঞায় শুধুমাত্র বর্ণবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শোষণ এবং অত্যাচার করাই বর্ণবাদ বা রেসিজম।
রেসিসম এর প্রসঙ্গে আমার অনেকদিন আগেকার একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। ল্যাবের কাজ শেষ করে ইউনিভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছি। সন্ধ্যা নামছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। খানিকটা আনমনা হয়ে ক্যামপাসের ভিতরের রাস্তা দিয়ে হাটছিলাম। আশেপাশে কে আছে খেয়াল করিনি। হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ শব্দ হলো ঠিক আমার সামনেই। শব্দটা একটা ছুরি খাপ থেকে খোলার মত। সামনে তাকাতেই দেখি আমার মুখের সামনেই একটি ঝকঝকে ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমার ভয় পাওয়া দেখে হেসে উঠলো ছুরি হাতে ১০/১২ বছরের ছেলেটি। গায়ের রঙ সাদা। আর একটি মেয়ে কুকুর নিয়ে ওর পাশে দাঁড়ানো। হাসিমুখে দাঁড়ানো ছেলে-মেয়ে দু’টিকে দেখে ভয় অনেকটা কমে গেল। হয়ত ওরা কেবল মজা করার জন্যই করছিলো এটা।
পরদিন সকালে ল্যাবে যেয়ে আমার এক ব্রিটিশ ল্যাব-মেটকে ঘটনাটা জানালাম। তার একটু পরেই ইউনিভার্সিটির সিকিউরিটি পুলিশ চলে আসলো আমার কাছে। পুরো ঘটনা শোনার পরে পুলিশ জানতে চাইলো আমি ছেলেটির বিরুদ্ধে অফিসিয়াল কমপ্লেইন করতে চাই কিনা। আমি ওদের বললাম, ওরা তো আমার কোন ক্ষতি করেনি। অফিসার জানালেন, আজ ক্ষতি করেনি কিন্তু বড় হয়ে সে ক্ষতি করবে। আমার মনে হয় তোমার কমপ্লেইন করা উচিত ছেলেটির ভালোর জন্য এবং সমাজের ভালোর জন্য। আমি জানতে চাইলাম, কমপ্লেইন করলে ওরা কী করবে ছেলেটিকে নিয়ে। ওরা জানালো, ওরা কয়েকটি সন্দেহভাজন ছেলেকে ধরে নিয়ে আসবে। আমাকে আড়াল থেকে তাকে সণাক্ত করতে হবে। এই বয়সে তার কোন শাস্তি হবে না, তবে তারা তাকে ওয়ার্নিং দেবে এবং তার দিকে খেয়াল রাখবে যাতে সে ভবিষ্যতে সমস্যা না করে। আমি খুব দ্বিধার মধ্যে পরে গেলাম। প্রথমত ছেলেটিকে চিহ্নিত করে ওর ক্ষতি করতে ইচ্ছে করলো না। দ্বিতীয়ত, এই পথ দিয়ে আমাকে রোজ আসা যাওয়া করতে হয়। ইচ্ছে করলে ওরা ঝামেলা করতে পারবে। আমার ল্যাবমেটরা আমাকে অফিসিয়াল কমপ্লেইন করতে বললো। আমার বন্ধুরা জানালো, এটা রেসিজম। আমার প্রতিবাদ করা উচিত। আমি সেদিন কিছুই করতে পারিনি। দ্বিধা এবং ভয় দুটোই কাজ করছিলো প্রতিবাদ না করার জন্য। আজ এতদিন পরে আমার মনে হচ্ছে কাজটা আমি ঠিক করিনি সেদিন। কমপ্লেইন করা উচিত ছিলো আমার।
আমার বন্ধুরা ঠিকই বলেছিল। আমার বদলে একজন সাদা হলে এই কাজটি ছেলেটি করতে সাহস করতো না। কারণ ওরা জানে সাদাদের দায়িত্ববোধ এবং সচেতনতা সম্পর্কে। সমাজের প্রতি ওদের দায়িত্ববোধ থেকেই ওরা ছেলেটিকে ছেড়ে দিত না। এখানেই ওদের সাথে আমাদের পার্থক্য। আমরা বিভিন্ন দুর্বল কারণ খাড়া করে দ্বিধার মধ্যে থাকি। প্রতিবাদ করতে পারি না। টরন্টোতেও রেসিজমের ঘটনা ঘটেছে আমার সামনে। এক সাদা মহিলা একটা কোকের ক্যান আমার প্রতিবেশীর মেয়ের মাথায় পুরোটা ঢেলে দিল বাসে ওঠার সময়। মা, মেয়ে কেউই কোন প্রতিবাদ করেনি। আমরা বাঙালিরা একটা কনফ্লিক্টের মধ্যে থাকি সব সময়। এখানকার পুলিশ সহায়তা করে। বাস ড্রাইভার সহযোগিতা করে, তার পরেও আমরা ভয় পাই। এভাবে যদি আমরা কেবলই দ্বিধার মধ্যে থাকি তাহলে সমাজের রেসিজমের দেয়ালটা কোনদিনই ভাঙা যাবে না।কানাডা বিভিন্ন জাতিস্বত্বার মানুষের দেশ। বিভিন্ন দেশের মানুষকে নিয়ে চলতে হবে আমাদের। আমরা এমন মানসিকতা ধরে রাখলে কোন ন্যাশনালিটির মানুষের সাথেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে না আমাদের। বন্ধুভাবাসম্পন্ন মানসিকতা না হলে রেসিজমকে দূরে সরিয়ে রাখার কাজটাও সহজ হবে না। ব্রিটেনে আমরা সবাই সবার বন্ধু ছিলাম। সাউথ-আমেরিকান, চাইনিজ, এরাবিয়ান, এশিয়ান, ব্রিটিশ, সবাই মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। প্রায়শয়ই দেখি, এখানকার ছেলে মেয়েদের বন্ধুত্ব শুধু বাঙালি কমিউনিটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে বেশিরভাগ সময়ে। তবে কি এখানে হিডেন রেসিজম ব্রিটেনের চাইতে বেশি? পথে ঘাটে, বাসে কোন সাদা কেনাডিয়ান ছেলে মেয়ের সাথে অথবা আফ্রিকান কোন ছেলেমেয়ে বা কোন চাইনিজ কোন ছেলেমেয়ের সাথে কোন বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা বন্ধুর মত কথা বলে না, বন্ধুত্ব করে না। এখানে কর্মক্ষেত্রে আমি অনেক সাদাকে এবং অন্যান্য দেশের মানুষকে দেখেছি অনেক ফ্রেন্ডলি। তারপরেও কেন ওদের সাথে আমাদের সখ্যতা হয় না? আমরা কি হীনমন্যতায় ভূগি? এই হীনমন্যতা আমাদের কী ইংরেজিতে জড়তার কারণে হয়েছে? আমাদের কি সঠিক শিক্ষার অভাব? আমাদের কি দেশের সংবিধান, আইন সম্পর্কে জ্ঞান কম? সমস্যাটা কোথায় তাহলে?
আমাদের ভয় থাকে এদেশে বসে প্রতিবাদ করে কীভাবে টিকে থাকবো। এটা কী আমাদের মজ্জাগত দৈন্যতা? দৈন্যতাটা কিসের? হতে পারে হতে পারে শিক্ষার অভাব। আমরা যখন নতুন আসি এদেশে, তখন নিয়ম কানুন ভালো করে জানা থাকে না। কনস্টিটিউশনাল অধিকার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কম থাকে। এই জ্ঞানটা আমরা আহরন করবো কী করে।
টরন্টোতে বিসিএস (Bangladeshi-Canadian Services) উদ্যোগ নিয়েছে রেসিজম এবং বৈষম্য কে নির্মূল করার জন্য। এটি বিসিএস এর নতুন ক্যামপেইন। এই রেসিজম ও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য বা মোকাবেলা করার জন্য বিসিএস দুইটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই দুই প্রকল্পে ৭৫ জন ইউথ কাজ করছে এবং করবে। এজন্য তারা সম্প্রতি একটি প্রজেক্ট Together End Recism in Toronto (TERT) লঞ্চ করেছে বিগত মার্চ, ২০২৪ থেকে যার কার্যক্রম চলবে এক বছর ধরে। একদল তরুণ দায়িত্ব নিয়েছে রেসিজমকে নির্মূল করার জন্য। বিসিএস এর আর একটি প্রজেক্ট Education and Allyship Program (EAP) হাতে নিয়েছেন ডিসেম্বর, ২০২৩ তে। এই প্রকল্পের আওতায় আরও একদল নিবেদিত প্রাণ তরুণ মিত্রতা বা Allyship এর মাধ্যমে কাজ করছে রেসিজম ও বৈষম্য কে মোকাবেলা করার জন্য। বিসিএস এদেরকে শিক্ষিত করছে রেসিজমের এবং বৈষম্যের বিরূদ্ধে রুখে দাড়ানোর জন্য, মোকাবেলা করার জন্য। জনগনের প্রতি তাদের আবেদন, রেসিজমকে নির্মূল করতে, বৈষম্যকে মোকাবেলা করতে এগিয়ে আসুন আর যোগদান করুন আমাদের সাথে। জানুন পদ্ধতিগুলো, কীভাবে রেসিজমকে এবং বৈষম্যকে রুখবে এই তরুণেরা। সমগ্র টরন্টোর এই রেসিজম এবং বৈষম্যকে ঘুচাতে এগিয়ে আসতে হবে সারা টরন্টোর জনগনকে। একই ভাবে সারা পৃথিবীব্যাপী পরিবর্তন আনতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে সারা বিশ্বের মানুষকে। সব মানুষকেই ভালোবাসতে হবে, বন্ধু বানাতে হবে। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, গায়ের বিভিন্ন রঙের চামড়ার নিচে সব মানুষই এক। কারণ কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারই সমান রাঙা।
Together End Recism in Toronto (TERT) প্রকল্পের কার্যক্রম বিস্তারিতভাবে দেখার জন্যঃ
Website/blog: https://endracismtoronto.ca/
Facebook Page: https://www.facebook.com/profile.php?id=61557351731037
Education and Allyship Program (EAP) প্রকল্পের এর কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য দেখুনঃhttps://www.bangladeshi.ca/post/building-communities-together-bcs-launches-education-and-allyship-program-to-counter-racism-and-dis
Comments